Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

ভাষা ও সাংস্কৃতি

                 

ভাষা ও সাংস্কৃতি

ভাষা ও সংস্কৃতি

সাতক্ষীরারভাষা ইন্দো ইউরোপীয় মূলভাষা হতে উদ্ভূত মাগধী প্রাকৃত (ড. সুনীতিকুমারচট্টোপাধ্যায়) মতান্তরে গৌড়ী প্রাকৃত (ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ) হতেবাংলাভাষার আধুনিক রূপ। উপমহাদেশীয় ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে সমগ্র বাংলাভাষীঅঞ্চল পাঁচটা উপ অথ্‌চলে বিভক্ত। বৃহত্তর যশোর ও খুলনা জেলাকে উক্তপঞ্চবিভাজনের মধ্যে বাঙ্গালী উপভাষা অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত।কিন্তুপ্রকৃতপক্ষে বৃহত্তর যশোর, খুলনা ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা(অবিভক্ত) জেলার দক্ষিণাঞ্চল বাঙ্গালী ও রাঢ়ী উপ ভাষার মিশ্রণে এর নবতরভাষারূপের সমাহার। ভারতেরকোলকাতা রাঢ়ী উপভাষার অন্তর্ভুক্তহওয়ারও মানচলিতভাষা একই রীতির অন্তর্ভুক্তহওয়ায় এবং সাতক্ষীরা জেলা কোলকাতারসন্নিকটস্থবলেসন্ধি এলাকার অবস্থাানের কারণে এই মিশ্র বৈশিষ্ট্য গড়ে ওঠায়একে "সুন্দরবনী উপভাষা"নামে অভিহিত করা হয়েছে।

(সাতক্ষীরার উপভাষা স্বরূপ ও স্বতন্ত্র; কাজী মুহম্মদ অলিউল্লাহ :১২২, ২০০৯)।

 

সাতক্ষীরার উপভাষায় রাঢ়ী ও বঙ্গালী রীতির সাধারণ ও মিশ্র বৈশিষ্ট ঃ

 

আগেইউল্লেখ করা হয়েছে যে, সাতক্ষীরার উপভাষা মূলত বঙ্গালী উপভাষার অন্তর্ভুক্তহলেও অবস্থানগত করাণে অবিমিশ্র বঙ্গালী বৈশিষ্টসমূহ সাতক্ষীরার কথা ভাষায়পুরোপুরি রক্ষিত নেই। তাছাড়া নানাবিধ কারণে উপভাষার বৃহত্তর পরিমণ্ডলেরভেতর সর্বত্র একই রীতি নিখুঁতভাবে বজায় থাকেনা। আঞ্চলিক বৈশিষ্টের দিক দিয়েযশোর জেলার ওপর রাঢ়ী প্রভাব অপেক্ষাকৃত বেশি, খুলনা জেলার ওপর সেক্ষেত্রেঅপেক্ষাকৃত কম এবং ফরিদপুরের ওপর আরো কম এবং বৃহত্তর খুলনা জেলারঅন্তর্ভুক্ত হলেও অবস্থানগত কারণে সাতক্ষীরা জেলার ওপর রাঢ়ী উপভাষার প্রভাবযশোরের থেকেও অপেক্ষাকৃত বেশি, বিশেষত দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে। সাতক্ষীরারউপভাষায় বঙ্গালী ও রাঢ়ী বৈশিষ্ট কতোটা ও কী পরিমাণ বিদ্যমান তার কয়েকটাগুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট উল্লেখিত হ’লো-

 

ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট ঃ

১.বঙ্গালী উপভাষার প্রধান বৈশিষ্ট হ’লো ক্রিয়াপদে অপিনিহিত উচ্চারণ বৈশিষ্ট।সাতক্ষীরা রউপভাষায় অপিনিহিতির ই বা উ আগম (বিপর্যাস) আছে ঠিকই, কিন্তুঅক্ষত অবস্থায় নেই। এখানে ই বা উ ধ্বনির আংশিক পরিবর্তন ঘটেছে। আর এইপরিবর্তন রাঢ়ী প্রভাবান্বিত-

যেমন- রাঢ়ীর মানচলিত রীতি- চলছে, চলেছে, চলেছিলো।

বঙ্গালী রীতি- চোইলতে আছে/চোইলতাছে, চোইলাছে, চোইলতেছিলো।

সাতক্ষীরার উপভাষা ঃ চোইলতেচে, চোইলেচে/ চোই লেচ্‌্‌ চোই লোলো।

লক্ষনীয় যে, রাঢ়ীর আগম ই ধ্বনি এখানে অর্ধলুপ্ত।

২. বঙ্গালী উপভাষায় উ আগম অপিনিহিতি রূপে পুরোপুরি ব্যবহৃত। যেমন- যাউকগিয়া, মাউরা, কাউল্যা ইত্যাদি।

রাঢ়ী বা মান চলিতে- যাগ্‌গে মেড়ো, কে’লো ইত্যাদি।

সাতক্ষীরারউপভাষায় শ্বদ মধ্যসি'ত আগম উ দ্ভনির বিলোপ ঘটেছে, তবে সেখানে অর্ধ ই (আগম)ক্ষতিপূরণ রূপে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন- জাই গ্‌গে / মেই ড়ো, কেই লোইত্যাদি।

 

৩.বঙ্গালী উপখাশায় শব্দের আদিতে এ ধ্বনির এ্যা / অ্যা প্রবণতা একটাগুরুত্বপূর্ণ উচ্চারণ রীতি। সাতক্ষীরার উপভাষায় সেটা সর্বত্র ব্যবহৃত হয়না। অনভিজাত, গ্রাম্য অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিতদের মধ্যে এবং বিশেষ ক’রেসুন্দরবন সন্নিহিত এলাকায় এই রীতি বজায় থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ জাতীয়এ্যা ধ্বনি ব্যবহৃত হয় না। বরং শিক্ষিত, অনভিজাতদের ক্ষেত্রে ঠিক উল্টোটাঘটে। যেমন-

রাড়ী/মান চলিত- তেল, বেল, বেতন, বেদনা এবং ইত্যাদি।

রঙ্গালী রীতিতে- ত্যাল, ব্যাল, ব্যাতোন, ব্যাদোনা, এ্যাবোং ইত্যাদি।

সাতক্ষীরারউপভাষায় দু’টোই রক্ষিত। তবে মানচলিতের রীতিটা সাধারণত শিক্ষিত, অভিজাতশ্রেণি ও শহরাঞ্চলে প্রযুক্ত হ’য়ে থাকে। পক্ষান্তরে অশিক্ষিত ও গ্রাম্যউচ্চারণে ঠিক তার উল্টোটা ব্যবহৃত হয়। যেম তেল>ত্যাল হয়।ব্যালা>বে-লা ইত্যাদি হয়। অর্থাৎবঙ্গালী প্রভাব পুরোপুরি মুক্ত নয়।

 

৪.বঙ্গালী অঞ্জল ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, নোয়াখলি প্রভৃতি এলাকায় আদ্য ও দ্বনি উধ্বণিতে রূপান্তরিত হয়। কিন্তুএই রীতি সাতক্ষীরার উপভাষা সর্বত্র প্রচলিতনেই। জেলার প্রান্তশ্যামনগর, সাতক্ষীরা সদর, কলারোয়া, তালা ওপ্রান্তআশাশুনি (খুলনা জেলা সংলগ্ন) উপজেলাতে এই রীতি প্রচলিত থাকলেওঅন্যত্র নেই। যেমন-

রাঢ়ী বা মানচলিত- ওদের, তোদের, তোমরা, হেলো ইত্যাদি।

সাতক্ষীরাজেলার কালিগঞ্জ সংলগ্ন শ্যামনগর, দেবহাটা ও আশাশুনি উপজেলা এবং শিক্ষিতদেরমধ্যে এই রীতি প্রচলিত। কিন্তুওপরে উল্লেখিত উপজেলতে উইগের, তুইগের, তুমার, হুইলো ব্যবহৃত হয়। উক্ত চারটে শব্দের প্রথম দুটোতে উ + ই (অর্ধ)অর্থাৎও> উই এবং শেষের দুটোতে ও> উ ব্যবহৃত হয়েছে। অধিকাংশক্ষেত্রে এই ধরনের উচ্চারণপ্রবণতা লক্ষ করা গেলেও প্রান্তচব্বিশ পরগণা (প.বাংলা. ভারত)-সংলগ্ন উপজেলাতে রাঢ়ী প্রভাবে মানচলিত রীতিই ব্যবহৃত হ’য়েথাকে। পূর্ব ও উত্তর পূর্বাঞ্চলে আদ্য উ ধ্বনি ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষ করাযায়। উল্লেখ্য যে, প্রথম দুটো শব্দ ওদের ও তোমার রাঢ়ী প্রভাবে যে সবএলাকায়আদ্য ও রক্ষিত সেখানে ওরগা/ওগা, তোরগা/তোগা ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎশুধুআদ্য ও টুকুই রক্ষিত। কিন্তুপরবর্তী ধ্বনি দের (বহুবচন) বঙ্গালী রীতিগের-এর বিপর্যাস ঘটেছে। যেমন-

(দের>) গের>রগে (বিপর্যাস)>রগ্না>(এ>আ)গা(মধ্য’র ধ্বনি লোপ) অর্থাৎতোদের>তোরগা/তোগা।

 

৫. অ/আদ্য আ-অন-ক ধ্বনিরূপে ফ. ভ মহাপ্রাণ বর্ণের উচ্চারণে বঙ্গালীতে অল্পপ্রাণিভবন ঘটে।

যথা- ভয়>বয়, ঘাট>গাট, কফ>কপ ইত্যাদি।

কিন্তুসাতক্ষীরারাউপভায় রাঢ়ী বা মান চলিত রীতিতেই ব্যবহৃত হয়। তবে খুলনা জেলা সংলগ্ন তালাউপজেলায় অনেকের উচ্চারণে বঙ্গালী রীতির টান লক্ষ করা যায়।

 

৬.বঙ্গালী উপভাষায় তাড়ন জাতীয় মূর্ধন্য স্বল্পপ্রাণ বা মহাপ্রাণ ধ্বণি ড়. ঢ়এর কোনে উচ্চারণ নেই। সে ক্ষেত্রে শুধু তাড়ন জাতীয় দন্তধ্বনিপার্শ্বিকধ্বনি র’ উচ্চারিত হয়। সাতক্ষীরার উপভাষাতে এ দুটো রাঢ়ী’র মতোইযথাযথভাবে উচ্চারিত হ’য়ে থাকে। শুধু তালা উপজেলার প্রান্তখুলনা জেলাসংলগ্নএলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে বঙ্গালী রীতির মতো র ধ্বনি উচ্চারিত হবার প্রবণতাবিদ্যমান। যেমন- বর (বড়)।

৭. বঙ্গালী উপভাষার প্রধান বৈশিষ্ট অপিনিহিতি, আর রাঢ়ী প্রধান বৈশিষ্ট অভিশ্রুতি ও স্বরসংগতি। যেমন-

ক. অভিশ্রুতি- ক’রে, দে’খে, রক্ষে, ভাগ্য ইত্যাদি।

অথচ বঙ্গালীতে(অপিনিহিতি) ঃ কোইর‌্যা, দেইখ্যা, রোইক্ষ্যা, ভাইগো ইত্যাদি।

খ. স্বরসংগতি-

সাধুরীতি- দেখিয়াছিল।

বঙ্গালীরীতি- দেইখ্যাছিল।

রাঢ়ী বা মানচলিত রীতি- দেখেছিল (দেখে= স্বরসংগতি)।

সাতক্ষীরার উপভাষা- দে/দিইকোলো। অর্থাৎ-

মাচভা বা রাঢ়ী- দেখেছিল (দ+এ+খ+এ+ছ+ই+ল+ও)

সাউভা-দে/দিইকোলা(দ+এই+ক(অল্পপ্রাণিভবন)+ও+(ছ+ই(লাপ)ল+ও)।

সাধুরীতি- মরিয়াছি

রাঢ়ী বা মানচলিত রীতি- মেরেছি (মেরে-স্বরসংগতি)

বঙ্গালী রীতি-মাইরাছি

সাতক্ষীরার উপভাষা- মারিচি (রিচি = স্বরসংগতি)।

 

৮.আদ্যক্ষর বা আদ্যধ্বনিতে শ্বাসাঘাত পড়া এবং পড়ার কারণে পরবর্তী শব্দ মধ্যেবা অনে- অল্পপ্রাণিভবন ঘটা রাঢ়ী রীতির একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট যেটাবঙ্গালীতে বিরণ ক্ষেত্র ছাড়া দেখা যায় না।

এই বৈশিষ্টটা সাতক্ষীরার উপভাষায় ব্যাপকভাবে লক্ষিত। যেমন-

মধু>মোদু, কাঁঠাল>কাঁটাল, সুখ>শুক ইত্যাদি।

বঙ্গালীতে মধ্য ও অন- ধ্বনিতে সাধারণত মহাপ্রাণধ্বনি ব্যবহৃত হ’য়ে থাকে।

 

৯. রাঢ়ীউপভাষায় কখনো কখনো সন্ধিজনিত কারণে, কখনো কারণ ছাড়াই অঘোষ ধ্বনিঘোষবৎউচ্চারিত হয়। যেমন-সন্ধিঘটিত- বটগাছ>বড্‌গাজ, পাঁচ ভরি> পাঁজভোরি ইত্যাদি।

এখানে পরবর্তী ঘোষধ্বনির প্রভাবে পূর্ববর্তী অঘোষে সমিভবন ঘটেছে। অর্থাৎ= ট+গ>ড+গ, চ+ভ>জ+ভ>জ+ব হয়েছে।

কারণ ছাড়া (বিষমিভবনে) ঃ কাক>কাগ, শাক>শাগ, ফুপু>ফুবু ইত্যাদি।

 

উল্লেখ্যযে, সাতক্ষীরার উপভাষায় এই ঘোষধ্বনির অঘোষ উচ্চারণ একটা স্বাভাবিক বৈশিষ্ট।মূলত গ্রাম উচ্চারণে এই বৈশিষ্ট ব্যাপকভাবে লক্ষ করা যায়। যেমন ঃ

খবর>খপোর, গরিব>গোরিপ, আসবে>আশপে, বাবা>বাপা, শাবা>শাপা, বাবু>বাপু, শাবল>শাপোল ইত্যাদি।

 

১০. রাঢ়ী উপভাষায় অ পরবর্তী ই বা উ ধ্বনি থাকলে আদ্য অ ধ্বনি এর উচ্চারণ ও হয়ে যায়, কিন' উপসর্গ অ এর উচ্চারণ অবিকৃত থাকে।

যেমন ঃ অতি>ওতি (অ পরবর্তী ই থাকায় ও তে রূপানি-রিত)।

অবিচার>অবিচার (রাঢ়ীতে আদ্য অ উপসর্গ হওয়ায় অ ধ্বনি অবিকৃত)।

কিন্তুবঙ্গালীতেওবিছার, ওশুখ, ওনীল হয়ে যায়। অর্থাৎআদ্য অ উপসর্গের ক্ষেত্রে অ ধ্বনিঅবিকৃত থাকে না। সাতক্ষীরার উপভাষায় এক্ষেত্রে রাঢ়ী রীতিটাই ব্যবহৃত হ’য়েঅবিচার, অশুক, অনিল হয়।

 

১১.বঙ্গালী উপভাষায় পদমধ্যসি'ত শ, স প্রবৃতি উষ্ম শিষ্‌ দ্বনি হ তে রূপান্তরিতহয়। কখনো কখনো ছ অর্থাৎঅঘোষ মহাপ্রাণ তালব্য ধ্বনিতে পরিণত হয়। যথা-

বস>বহো. সে>হে. আসে>আহে, সকল>হগোল ইত্যাদি (ইম্ম শিস ধ্বনি)।

সময়>ছোমায়, বিশাল>বিছাল, বাস>বাছ, শ্বাসাঘাত>ছাছাগাত ইত্যাদি (অঘোষ মহাপ্রাণ তালব্য ধ্বনি)।

 

সাতক্ষীরারউপভাষাতে খুলনা জেলা সংলগ্ন তালা বাদে অন্যান্য উপজেলার প্রায় সর্বত্রইশ,স এর সঠিক উচ্চারণ প্রচলিত, যা রাঢ়ী বৈশিষ্টের ফল। তবে শিশু, নারী এবংবিশেষত হিন্দু নারীদের উচ্চারণে ২নংবৈশিষ্ট অর্থাৎছ/চ ধ্বনি ব্যবহৃতহবারপ্রবণতা লক্ষ করা যায়।

 

১২. শব্দমধ্যসি'ত ক ধ্বনি বঙ্গালী উপভাষায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে অ ধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়। যথা-

সকল>শোআল, টাকা>টাআ/টেকা ইত্যাদি।

কালিগঞ্জ, শ্যামনগর, দেবহাটা, সাতক্ষীরা সদর ও আশাশুনির প্রায় সর্বত্র এবং যশোর ওখুলনা জেলা সংলগ্ন তালা ও আশাশুনির কিছু এলাকা ছাড়া সর্বত্র শব্দমধ্যসি'ত কধ্বনি স্বাভাবিকভাবে উচ্চারিত হয়।

 

১৩.যশোরসংলগ্ন তালা উপজেলা এবং খুলনাসংলগ্ন আশাশুনি উপজেলার কিছু অংশ বাদেসাতক্ষীরা জেলার সর্বত্রই অসংখ্য শব্দে রাঢ়ী বৈশিষ্টের প্রভাবেস্বতোনাসিক্যভবন ঘটে। যেমন-

কাচ>কাঁচ, হাটু>হেঁইটো, ঝাটা>ঝ্যাঁটা, শাকো>শাঁকো, শোডা>শোঁটা ইত্যাদি।

 

১৪.রাঢ়ীতে উত্তর পুরুষের অতীতকালের ক্রিয়াপদে লুম, লেম, নু ইত্যাদিব্যবহৃতহয়্‌।সাউভাতে সেক্ষেত্রে শুধু লাম এবং দক্ষিণ চব্বিশপরগণারকিছু অভিবাসীদেরউচ্চারণে নু ব্যবহুত হয়্‌ যেমন- জাবানু, হবানু, খাবানু ইত্যাদি। সাউভাতেভবিষ্যৎকালে অবশ্য এ্যনে/আ্যান্‌ ব্যবহৃত হয়। যেমন- হব্যানে/ন্‌, দ্যাকপানেইত্যাদি।

 

১৫.রাঢ়ীতে প্রথম পুরুষের অকর্মক ও সকর্মক উভয় ক্রিয়ার অনে- ল, লে যুক্ত হয়।সাউভাতে অভিজাতদের মধ্যে লে এবং অনভিজাত শ্রেণীর মধ্যে এ্যালে ও ল্যাব্যবহৃত হয়। যেমন- লেবো, লেইশো, লেচো (অভি) ইত্যাদি।

 

১৬. কোনোকোনো ক্ষেত্রে বঙ্গালী উপভাষায় কিছু কিছু শব্দে অস্থানে স্বতোনাসিক্যভবনঘটে। যথা- টাকা>টেআঁ, আমি>আঁই (এখানে ম এর বিকল্পে চন্দ্রবিন্দু(আনুনাসিক) ব্যবহৃত হয়েছে), বই>বোঁই ইত্যাদি।

সাতক্ষীরার কোন অঞ্চলে এ জাতীয় উচ্চারণ লক্ষ করা যায়না।

 

১৭.সাতক্ষীরার উপভাষার শব্দের আদিতে বা মধ্যে হ শিস ধ্বনির যথাযথ প্রয়োগ একটাস্বাভাবিক বৈশিষ্টের অন্তর্ভুক্ত, যা বঙ্গালী উপভাষার রীতি বিরুদ্ধ।সাতক্ষীরার এই বৈশিষ্ট রাঢ়ী প্রভাবের সংঘটিত। কিন্তুকালিগঞ্জ, শ্যামনগর ওশ্যামনগর সংলগ্ন আশাশুনি উপজেলায় এবং বিশেষত অনভিজাত ও অল্পশিক্ষিতদের ভেতরশব্দের আদিতে অ ধ্বনির উচ্চারণে হ ধ্বনি প্রবণতাও একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্যেরঅন্তর্ভুক্ত। যেমন-

এত>হ্যাতো, এখন> হ্যাকোন, অমন> হমোন, অত>হতো, এ্যাতো>হ্যাতো>হেইত্তে, এমনি>হেমনি, একুশ> হেকুশ, এ>হে ইত্যাদি।

১৮.স্বতোনাসিক্যভবন রাঢ়ীর একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট। এর বৈশিষ্ট সাউভার দক্ষিণপশ্চিম এলাকাকে প্রভাবিত করছে। উত্তর ও উত্তর পূর্বএলাকায় এই বৈশিষ্ট কোনোপ্রভাবিত করতে পারেনি।

 

রূপতাত্বিক বৈশিষ্ট ঃ

 

১. বঙ্গালী উপভাষায় কর্তৃকারকে (নির্দিষ্ট ও অনির্দিষ্ট কর্তায়) এ/য় বিভক্তি যুক্ত হয়;যথা-রামে কয়, বাবায় বারি নাই ইত্যাদি।

কিন্তুসাতক্ষীরারউপভাষায় রাঢ়ী রীতি অনুযায়ী কর্তৃকারকে শূণ্য বিভক্তি প্রযুক্ত হয়। যথা-রাম বলে, বাব বাড়িনি / বাইড়ুনি>বাইন্নি (সমিভবন) ইত্যাদি।

 

২.বঙ্গালীতে মুখ্য ও গৌণ কর্মে কে স্থলে রে বিভক্তি ব্যবহৃত হয়। সাতক্ষীরারউপভাষায় এই রে বিভক্তি শব্দান্তেআঞ্চলিক প্রয়োগে অনেক ক্ষেত্রে রি ঘটেথাকে। যেমন- করিম্‌রি দ্যাও, হরিরি দ্যায় (<দিয়ে আয়) ইত্যাদি। তবে তারে, ওরে, আমারে, হেরে ব্যবহৃত হ’য়ে থাকে।

 

দ্রুতউচ্চারণে রে> র হ’য়ে যায়। এমনকী সমীভবনের ক্ষেত্রে পুরো বিভক্তিটাইলুপ্ত হয়ে যায়। করিমকে বলো> কোরিমির / কোরিমরি বলো। জ্যোতিকে ডাক্‌্‌> জ্যোতিইড্‌‌ডাক। হরিকে দিয়ে আয়>হোরিরি দে আয়> হোরিদ্ধ্যায়/ হো /হুইরেদ্দ্যায় ইত্যাদি।

এক্ষেত্রেদ্রুত উচ্চারণে জ্যোতিরি> জ্যোতির> জ্যোতিড্‌ (জ্যোতির)ডাক =অর্থাৎর+ড = সমীভবনে ডড’) হয়ে যায়। অর্থাৎদ্বিতীয় বিভক্তির আর অস্তিত্বথাকে না।

 

৩. বঙ্গালীতে অধিকরণে ত বিভক্তি ব্যবহৃত হয়।

যেমন- বারিত্‌ যামু, ঘোরিত্‌ কডা বাইজ্‌ছে/জে ইত্যাদি।

সাতক্ষীরারউপভাষায় ত বিভক্তি তি হ’য়ে যায়। আবার গ্রাম্য উচ্চারণে বিপর্যাস ঘটে। যথা-নোদিতি গাধুতি গেলাম। তোগা বাড়িতি কেডা এইয়েচ্‌রে? ইত্যাদি।

দ্রুতউচ্চারণে এই তি (ত+ই) এর বিপর্যাস ঘটে ইত্‌‌ (ই+ত্‌) হয়। অর্থাৎনোদিত্‌গাধুইত্‌ জাবো/নোদিত্‌ গা ধুইজ্জাবো (ত+জ=জজ সমীভবন) বাড়িতে> বাড়িইত্‌ ।এখানে ই বিপর্যাসটা শ্রতিধ্বনির মতো উচ্চারিত হয়।

 

৪.বহুবচনের ক্ষেত্রে বঙ্গালীতে গো এবং রাঢ়ীতে দের ব্যবহৃত হয়।কিন্তুসাতক্ষীরার উপভাষায় রাঢ়ী’র দের বিভক্তির পরিবর্তিত প্রয়োগ ঘটে। যেমন-

ক. মধ্য, উত্তর ও উত্তর-পূর্ব এলাকায় = ইগের (<দের>গের> ইগের) হয়। যথা- আমাইগের, উইগের, আম্‌্‌নাইগের ইত্যাদি।

খ. দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকায়-

দের>গের>রগে(বিপর্যাস)>রগা (এ>আ)>গা (দ্রুত উচ্চারণে র’ লোপে ব্যবহৃত হয়)। যথা-

আমরগা, তোরগা, আপ/মোনারগা, তাগা, তোগা, আমাগা ইত্যাদি। তবে সাতক্ষীরার সর্বত্রঅশিক্ষিত বা অনভিজাত গ্রাম্য উচ্চারণে উত্তম ও মধ্যম পুরুষে সঙকুচিত হ’য়েআঙ্গা, তোঙ্গা

ব্যবহৃত হয়।

 

৫. রাঢ়ীতে সাধারণ বর্তমানের রূপ বঙ্গালীতে ঘটমান বর্তমানের রূপে ব্যবহৃত হয়। যথা- মা ডাকে (রাঢ়ী রীতি= সাধারণ বর্তমান)।

মায়ে ডাকে(বঙ্গালী রীতি ঘটমান বর্তমান)। কিন্তুসাউভাতে ঘটমান বর্তমানে মাডেইক্‌তেচে/চ্‌‌ ব্যবহৃত হয়। ঘটমান বর্তমানের ক্ষেত্রে এখানে ভগ্ন অপিনিহিতব্যবহৃত হ’য়ে থাকে। অর্থাৎরাঢ়ী বঙ্গালীর মিশ্রণ রীতির মতো ব্যবহৃত হয়।

 

৬. রাঢ়ীতে ঘটমান বর্তমানের বিভক্তি বঙ্গালীতে পুরাঘটিত বর্তমানের রূপে ব্যবহৃত হয়। যথা-

বঙ্গালী- আমি/আঁই করশি/কশ্‌শি (পরাঘাটিত বর্তমান = করছি)।

রাঢ়ী- আমি করছি (ঘটমান বর্তমান)।

 

সাতক্ষীরার উপভাষা-

আমি কোত্তিচি/কোত্তিচ্‌ (ঘটমান বর্তমান) এখানে-

৭. বঙ্গালীতে সাধারণ ভবিষ্যৎকালের মধ্যম পুরুষে বা এবং রাঢ়ীতে বে ব্যবহৃত হয়। যথা-

বঙ্গালী- তুমি যাইবা, দেইখ্‌বা, বোইল্‌‌বা ইত্যাদি।

রাঢ়ী- হুমি যাবে, দেখবে, ব’লবে ইত্যাদি।

কিন্তুসাতক্ষীরার উপভাষায় বঙ্গালী রীতি অনুযায়ী অনে- বা ব্যবহৃত হ’লেও রাঢ়ী প্রভাবে মধ্যবর্তী ই ধ্বনির লোপ ঘটে।

যথা- তুমি জাবা, দ্যাকপা (<দেখবা), বলবা ইত্যাদি।

 

৮. উত্তম পুরুষের সাধারণ ভবিষ্যৎকালে বঙ্গালীতে কোথাও মু তাম কোথাও আম বিভক্তি ব্যবহৃত হয়। যেমন ঃ

ক. আঁই/আমি যামু না।খ. আমি/আঁই যাইতাম না।গ. আমি/আঁই যাইয়াম না।

তবে বৃহত্তর নোয়াখালিতে আঁই জাইতেন্‌ ন/নো হয় (ম+ন>ন্ন)।

কিন্তুরাঢ়ীতে ব বিভক্তি ব্যবহৃত হয়। এবং ব>বো হয়।

যথা- আমি যা না/যাবোনা। সাতক্ষীরার উপভাষাতেও আমি জাবোনা ব্যবহৃত হয়।

 

৯. রাঢ়ীতে অতীত কালের ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত নঞ্‌র্থক অব্যয়ের ক্ষেত্রে নেই, নি এবং বঙ্গালীতে নাই ব্যবহৃত হয়।

সাতক্ষীরাউপভাষাতেও নি ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া রাঢ়ীতে যে সব জায়গায় নেই এবং বঙ্গালীতেনাই ব্যবহৃত হয়- সাতক্ষীরাতে সেখানে নি ব্যবহৃত হয়। যথা-

ক. লতা বাড়ি নেই = রাঢ়ীখ. লতা বারি নাই = চঙ্গালী

গ. লোতা/নোতা/নতা/লতা বাড়ি নি/বাইড়্‌নি (বিপর্যাস অর্ধ’ই)/বাইন্নি (ড়+ন=ন্ন=সমিভবন) হয়।

১০. অসমাপিকা ক্রিয়ার ক্ষেত্রে।

ক. রাঢ়ী- দিয়ে = আমি দিয়ে দিয়েছি।খ. বঙ্গালী- দিয়্যা = আমি / আঁই দিইয়্যা দিছি।

গ.সাতক্ষীরা উপভাষায় দে = আমি দে দিচি/চ্‌‌। এখানে দে<দিয়ে (রাঢ়ী’ প্রভাব), দিচি< দিছি (বঙ্গালী প্রভাব এবং অনে- চ’ অল্পপ্রাণিভবন রাঢ়ীবৈশিষ্ট।

দিচ্‌< দিচি (দ্রুত উচ্চারণে অন- ই লোপ)। এরূপ ধ্বনি সংকোচন প্রায়শ ঘটে থাকে।

 

১১. তুম’ র্থক অসমাপিকা ক্রিয়াপদে-

ক. বঙ্গালী- তা’ / তে বিভক্তি = যাইতে/যাইতা, কোইর্‌তা/কইর্‌তে ইত্যাদি।

খ. রাঢ়ী- তে = স্বরসঙ্গতি রূপে = যেতে, খেতে, বলতে।

গ. সাতক্ষীরার উপভাষায়- জাতি, খাতি, বোল্‌তি ইত্যাদি।

এই বৈশিষ্ট বৃহত্তর যশোর, খুলনা ও চব্বিশ পরগণার দক্ষিণাঞ্চলের বহু জায়গায় ব্যবহৃত হয়।

 

১২. শুধু অসমাপিকা ক্রিয়া নয় শব্দানে- ই’র প্রয়োগ সাতক্ষীরার উপভাষায় নানাভাবে ঘ’টে থাকে। যেমন-

ক. সপ্তমী বিভক্তিতে - নাতি, জাতি, বোল্‌তি ইত্যাদি ।

খ. ষষ্ঠী বিভক্তিতে - মান্‌শির (মানুষের), পুতির (পুতের), শালিকির(শালিকের), বিলির(বেড়ালের)

ইত্যাদি ।

গ. অতীত কালের ‘ল’ প্রত্যয়ে -

দিলি, গে/গিলি, চোল্‌লি, কো’লি(কইলে) ইত্যাদি ।

ঘ. পুরাঘটিত অতীতে -

পোড়িচি(পেড়েছি), বোলিচি(বলেছি), হাঁশিচি(হেসেছি), দেকিচি(দেখেছি) ।

উল্লেখ্য যে, এসব ক্ষেত্রে দ্রুত উচ্চারণে সাতক্ষীরার উপভাষায় অন- ‘ই’ লোপ পায় । যেমন - গিচ্‌,

চোলিচ্‌, হাঁ/হাশিচ্‌ ইত্যাদি ।

ঙ. ক্ষুদ্রাকৃতি ও গুটি অর্থে -

লেদি/নেদি, খেঁদি, কোচি (ছোট মেয়েকে সম্বোধন), আবড়ি/ আউড়ি (গোলার মতো বৃহৎধান রাখার

পাত্র) ইত্যাদি ।

চ. ঝোঁক ও গুরুত্ব প্রদানে - গেলি,আলি (এলি),বোল্‌লি, শুন্‌লি, দেক্‌লি ইত্যাদি ।

ছ. নিম্নধ্বনি উচ্চারণে - বোল্‌তি (বলতে), খাতি (খেতে), কোতি (কইতে) ইত্যাদি ।

জ. স্বরসাম্যে - দি (<দিই), নি(<নেই) ইত্যাদি ।

সবশেষেবলা যায়, সাতক্ষীরা জেলা মূলত বৃহত্তর বঙ্গালী উপভাষা অঞ্চল ও রীতিরআওতাভুক্ত । কিন্তুপ্রান্তরাঢীয় এলাকায় অবস্থানের কারণে ‘রাঢ়ী’ প্রভাবেস্থানীয় বঙ্গালী রীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে । ফলে, বঙ্গালী ও রাঢ়ীরীতির মিশ্রণে সাতক্ষীরার উপভাষায় মিশ্রবৈশিষ্ট গ’ড়ে উঠেছে ।

 

সাতক্ষীরার উপভাষার আঞ্চলিক পরিধি

 

সাতক্ষীরার আঞ্চলিক বৈশিষ্টগুলোকে নিম্নোক্তভাবে এলাকাভিত্তিক ভাগ করা যেতে পারে-

১. উত্তর ও উত্তর পূর্ব - যশোর জেলাসংলগ্ন তালা ও কলারোয়া উপজেলা এবং খুলনা জেলা সংলগ্ন তালা ও আশাশুনি উপজেলা ।

২. মধ্য- সাতক্ষীরা সদর উপজেলা ও তৎসংলগ্ন তালা, কলারোয়া, আশাশুনি ও দেবহাটা উপজেলা ।

৩. দক্ষিণও দক্ষিণ পশ্চিম - কালিগঞ্জ, শ্যামনগর, কালিগঞ্জ ও দেবহাটা উপজেলাসংলগ্নআশাশুনি ও দক্ষিণ-চব্বিশ পরগণা/পশ্চিম বাংলা, ভারত সংলগ্ন দেবহাটা উপজেলা ।

 

মধ্যাঞ্চলেসাতক্ষীরা জেলা শহর অবস্থিত । নাগরিক জীবন-যাত্রা এবং শিক্ষা, সংস্কৃতি,রাজনীতি, অফিস-আদালত ও সর্বপ্রকার প্রতিষ্ঠানিক সুযোগ সুবিধেরকারণে মানচলিতের প্রভার লক্ষ করা যায় । এ বৈশিষ্ট মূলত বাহ্যিক ও কৃত্রিম ; সামগ্রিকভাবে তা আঞ্চলিক ভাষাকে প্রভাবিত করতে পারেনি । তা ছাড়া সামাজিকপ্রয়োজনে এখানে যে মানচলিত ভাষা ব্যবহার করা হয়,উচ্চারণে তাতে ঔপভাষিকবৈশিষ্ট (টান) বজায় থাকে । সামগ্রিকভাবে মধ্যাঞ্চলের ভাষায় ঔপভাষিকবৈশিষ্টই বিরাজিত । এছাড়া থানা সদরগুলো উপজেলায় রুপান্তরিত হওয়ায় - যাতায়াতব্যবস্থার দ্রুত উন্নতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি ও নানা প্রকার গণমাধ্যমসুবিধের কারণে উপজেলা সদর ও শিক্ষিত সম্প্রদায়ের কথায় মানচলিতের কিছুপ্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে; যদিও তা বাহ্যিক এবং আঞ্চলিক বৈশিষ্ট ওউচ্চারণরীতি মুক্ত নয় ।

 

দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলের প্রান্তদিক্ষণ সীমা সুন্দরবন সংলগ্ন শ্যামনগর উপজেলা ।প্রান্তসুন্দরবন এলাকায় বৃটিশ আমলে আদিবাসী অভিবাসন ঘটায় এখানকার কথ্যভাষায়কিছু কিছু আদিবাসী শব্দের প্রভাব ও উচ্চারণ রীতি বিদ্যমান । তবে, সামগ্রিকভাবে শ্যামনগর, কালিগঞ্জ, দেবহাটা ও কালিগঞ্জ-দেবহাটা সংলগ্নআশাশুনি উপজেলা পার্শ্ববর্তী জেলা চব্বিশ পরগণা ( পশ্চিমবাংলা, ভারত) তথামানচলিতের প্রভার অপেক্ষাকৃত বেশি ।

 

উত্তর ওউত্তর পূর্বাঞ্চল খুলনা জেলা সংলগ্ন তালা ও আশাশুনি উপজেলায় খুলনা ,ফরিদপুরও বরিশাল জেলার কিছুটা ভাষিক প্রভাব লক্ষ করা যায় । অন্যদিকে যশোর জেলাতালা ও কলারোয়া উপজেলায় ‘যশুরে’ ভাষার প্রভাব বেশি । তবে সামগ্রিক বিচারেতিন অঞ্চলের কথ্য ভাষায় পারস্পরিত ভিন্নতা ও স্থানিক বৈশিষ্ট নিতান্তইসামান্য ।

এই উপভাষার সাথে প্রধানত যশোর এবং মোটামুটি চব্বিশ পরগণার (দক্ষিণাংশ, পবঙ্গ, ভারত) ও খুলনা জেলার ঔপভাষিক বৈশিষ্ট সামঞ্জস্যপূর্ণ ।

 

সাহিত্য:

 

দক্ষিণবাংলার প্রাচীন জনপদ সাতক্ষীরা । পলি সঞ্চিত বিস্তৃর্ণ সমতল উর্বরভূমি,বন-বনানী শোভিত -লিলায়িত ভঙ্গির অনবদ্য ছবির মতো ইতিহাস ভূগোলেরনৃতত্বের ত্রিবেনী সঙ্গমে গড়া গাঙ্গেয় বদ্বীপের বাঘ্রতটটি সাহিত্য ওসাহিত্য প্রেমিকদের স্বর্ণভূমি । এ অঞ্চলের সাহিত্য চর্চার ইতিহাসটি অনেকপুরাতন ফরাসি গবেষক সিলভী লেডির মতে মাননাথ বা মৎসেন্দ্রনাথ এই অঞ্চলেরঅধিবাসি । চর্চাপদের এই পদক্তাতে এই অঞ্চলের সাহিত্যের আদিম দেবতা মনে করাযায় । ১২শ শতকের দিকে বিশাল আর্থতার সংস্কৃতির উত্তরাধিকার হিসেবে বিচিত্রধর্মবোধের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত মোর্গী সম্প্রদায়ের মধ্যে শিব গাজনেরপালকারবৃন্দের আর্বিভাব এই অঞ্চলের প্রাচীনত্বকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে । এইসময়ে যোগেন্দ্রনাথ, সুরেন্দ্রনাথ, শ্রী কালিপ্রসাদ, হরিপদ নাথ পরবর্তীতেবিধুভূষণদেব বর্মন প্রমূখ এ ধারায় সাহিত্য চর্চা করেন । এদের মধ্যেযোগেন্দ্রনাথের রাধাকৃষ্ণের দ্বন্দ্ব, প্রমিলার আক্ষেপ, সিন্দুবধ, সাবিত্রীসত্যবান প্রভৃতি পালা ও কাহিনীকাব্যকে শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন উচ্চ মূল্যেরসাহিত্যকর্ম মনে করেন ।

 

শ্রীচৈতন্যদেবেরবৈষ্ণব ধর্ম আশ্রিত কবি যবন হরিদাস ১৩ শতকে কবিতা চর্চায় বিশেষ অবদানরাখতে সক্ষম হয়েছেন । ১৫ শ শতকে বসন্তরায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় বৈষ্ণব পদকর্তাকবি গোবিন্দদাসের কবিতা চর্চা করার নিদর্শন পাওয়া যায় । প্রতাপাতিদ্যেররাজসভায় আবলম্ব সরস্বতী ও তার ভাই ডিম ডিম সরস্বতির সাহিত্য চর্চা করার কথাসতীশ মিত্র তার যশোর-খুলনার ইতিহাস গ্রন্থ উল্লেখ করেছেন । কিন্তু সাহিত্যচর্চার এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকার চিহ্ন খুজে পাওয়া যায় না । বরং দীর্ঘবিরতিতে দেখা যায় বাংলা গদ্য চর্চার দ্বিতীয়ধাপে অর্থাৎ১৮ শতকের মধ্যভাগেসাতক্ষীরার বেশ কয়েকজন সাহিত্যিক নিষ্ঠার সাথে সাহিত্যচর্চা করে গেছেন ।গবেষক কাজী মোহাম্মদ অলিউল্লাহর মতে ১৮৬১ সালে সাতক্ষীরার প্রশাসনিকপরিবর্তন বিশেষ করে মহকুমার রুপান্তর । পি এ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়েরপ্রতিষ্ঠা, ১৮৬৩ সালে সাতক্ষীরার প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট নবাব আব্দুল লতিফকর্তৃক মুসলিম সাহিত্য সমাজ গঠন, ১৮৮৫ সালে ভারতীয় কংগ্রেসেরআত্মপ্রকাশ,এতদাঞ্চলের মানুষদের সাথে কলকাতা কেন্দ্রিক মূলধারায় অধিকসম্পৃক্ততা ইত্যাদি কারণে মূলত এই সময়ে সাহিত্য চর্চার বিকাশ ঘটতে শুরু করে। এই সময়ে যারা সাহিত্য ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেনতাদের মধ্যে ঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায় (১৮৫১-১৯০৩), খানসাহেব আব্দুল ওয়ালী(১৮৫৫-১৯২৬), আজিজুননেছা খাতুন (১৮৬৪-১৯৪০), খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ(১৮৭৩-১৯৬৫), মুন্সী জিন্নাতুল্লাহ আনসারী (১৮৭৬-১৯৬৫), মাওলানা আহমদ আলী(১৮৮২-১৯৭৭), মাওলানা ফয়েজ উদ্দীন হামিদী (১৮৯৫-১৯৭০), মোহাম্মদ ওয়াজেদআলী(১৮৯৬-১৯৫৪), মোহাম্মদ আফিলউদ্দীন আহমদ(১৯১৫-১৯৬৫) প্রমুখ প্রধান ।প্রাবন্ধিক গাজী আজিজুর রহমানের মতে এরা মূলত সবাই ধর্মকে বিষয় হিসেবে বেছেনিয়ে তার চর্চা ও অনুশীলনে নিমহিত ছিলেন এবং একমাত্র মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীএই অশৈল্পিক ভার থেকে সাতক্ষীরার সাহিত্যকে মুক্ত করতে  সক্ষমহয়েছিলেন ।লক্ষনীয়  এরা মূলত গদ্যচর্চা করেছেন এবং এদের মধ্যে ঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায়, খানসাহেব, আব্দুল ওয়ালী ও আজিজুননেছা খাতুনের গদ্য চর্চার পাশাপাশিকাব্যচর্চাও করেছেন । আজিজুননেছা খাতুন সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে প্রথম মুসলিমকবি ও অনুবাদিকা ।

 

১৯৪৭সালের দেশ বিভাগের পর একই সাথে কলকাতা ও ঢাকা কেন্দ্রিক সাহিত্য চর্চারদ্বিমুখী স্রোতের প্রভাবে সাতক্ষীরার সাহিত্য একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্টেরচিহ্ন বুকে ধারণ করে অগ্রসর হতে থাকে । উনিশ শতকের ধারাবাহিকতায় আব্দুলওহাব সিদ্দিকী (১৯০১-১৯৮৫) অধ্যাপক শ্রী নিবাস ভট্টাচার্য (১৯২৭-) অশোককুমার ভঞ্জ চৌধুরী (১৯২৪-) ডাঃ আহসান উল্লাহ (১৯২৩-)

............উদ্দীনখাঁ (১৯৩০-১৯৯৫) মুল্লুক চাঁদ গাজী (১৯২৮ আনুমানিক) মোহাম্মদ ইউনুস (১৯২৮আনুমানিক) প্রমুখ সাহিত্য চর্চার ধারা অব্যাহত রাখেন ।

 

এই দুইপর্বের দু’জন উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিক হচ্ছেন মোবারক আলী খান (১৮৮৮-১৯৭১) এবংসিকান্দার আবু জাফর (১৯১৮-১৯৭৫) । মোবারক আলী খানের উল্লেখযোগ্যসাহিত্যকর্ম হচ্ছে বাংলা সনের জন্ম কথা । তার পান্ডিত্য,বিজ্ঞান মনস্কঅসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং তাঁর সমকালের তুলনায় অগ্রসর চিন্তার কারণে তিনিবিশেষভাবে খ্যাতিমান হয়ে আছেন ।

 

সিকান্দার আবু জাফর এদেশের সাংবাদিকা, সাহিত্যসাধনা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক। সমকাল সম্পাদনা তার অন্যতম প্রদান  সাহিত্যকৃর্তি ।

 

৬০এর দশকসাতক্ষীরায় সাহিত্যে পালা বদলের কাল । গদ্য-পদ্য দু’ধারায় অসংখ্যসাহিত্যিকের পদচারণায় মুখর এই সময়ে অনেকের খ্যাতি সাতক্ষীরায় সীমিত পরিসরজাতীয় পর্যায়েও পরিব্যক্ত হয় । এ সময়ের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মীরা হলেনশেখ মোহাম্মদ কওছার আলী (১৯১৯-১৯৯১), আনিছ সিদ্দিকী (১৯৩৪-১৯৮৫), আবুলকালাম মহিউদ্দিন (১৯৩৪), এখলাস উদ্দীন সরকার(১৯৩৪), শেখ শামসুররহমান(১৯৩৬-১৯৯৫), ড. মোমেন চৌধুরী (১৯৩৬-২০০৮), আল কামাল আবুলওহাব(১৯৩৮-২০০৮), তবিবুর রহমান(১৯৩৮-১৯৮৪), শাহেদা খানম(১৯৩৮-২০০৭), আ স মবাবর আলী (১৯৪২), আবু জাফর (১৯৪২), গোলাম মঈনউদ্দীন (১৯৪৪), আজমল হক প্রমূখ।

 

বাঙালিরমহত্তম অর্জন সমূহের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিতস্বাধীনতা অন্যতম । স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সাতক্ষীরার সাহিত্য পত্রপুষ্পেসুশোভিত হয়ে সাতক্ষীরা সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে । ৬০ এর দশকে সাহিত্যচর্চা শুরু করলেও পরবর্তী সময়েসময়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন । এমন বেশ কয়েকজনসাহিত্যিক স্থানীয় আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন । এরকমকয়েকজন হলেন খায়রুল বাসার (১৯৪৮), গোলাম সরদার সিদ্দিকী, হাসান আব্দুলখালেক(১৯৪০), তৃপ্তি মোহন মল্লিক(১৯৪৩), গাজী আজিজুর রহমান, আফজালুলবাসার(১৯৫৭), ইয়াসমিন জাহান শাহীন প্রমুখ ।

 

 

প্রসঙ্গতউল্লেখ্য যে, উল্লেখিতদের মধ্যে ড. মোমেন চৌধুরী গবেষণায় , আনিস সিদ্দিকীইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস রচণায়, আল কামাল আব্দুল ওহাব ও তবিবুর রহমান শিশুসাহিত্যে বিশেষভাবে অবদান রাখতে  সক্ষম হয়েছেন ।

 

দীর্ঘদিনধরে সাতক্ষীরায় গবেষনার  মতো একটি শ্রমসাধ্য বিষয়ের চর্চা ও প্রবন্ধসাহিত্য নিয়ে কাজ করছেন কাজী মুহম্মদ অলিউল্লাহ । ইতিমধ্যে তার উপভাষাগবেষণা বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার পন্ডিতমহলে সমাদৃত হয়েছে ।

 

গত শতকেরশেষ দুই দশক এবং এ শতকের ১ম দশক হচ্ছে সাহিত্যিক বৃত্ত থেকে ছড়িয়ে পড়ার কাল। এককভাবে কেহ সাহিত্যের চূড়াস্পর্শ করতে না পারলেও এই সময়ের নিরলসসাহিত্য কর্মীরা সাতক্ষীরা সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ও বগেবান করে তুলতেউজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে চলেছে । এই সময়ের উল্লেখযোগ্য কয়েকজন সাহিত্যকর্মীহচ্ছেন মুফতি আব্দুর রহিম, ড. মিজানুর রহমান, আফজাল হোসেন, আব্দুলকাদিম,অধ্যাপক মোঃ আবু নাসের, আব্দুল ওহাজআজাদ, আতা রহমান, আবুল হোসেনআজাদ, সিরাজুল ইসলাম, পল্টু বাসার, শেখ নজরুল ইসলাম, গাজী শাহজাহান সিরাজ, সালেহা আখতার, শুভ্র আহমেদ, আবু সুফিয়ান সজল, মনিরুজ্জামান ছট্টু, ইমরুলইউসূফ, নরেন্দ্র সুগন্ধ্যা, নিশিকান্তব্যানার্জী, সঞ্চয় মনির, আহমদসাব্বীর, নাজমুল হাসান প্রমুখ ।

 

৬০ এরদশকের বাংলা কবিতা বিষয় ও বিন্যাসে ছিল দ্রোহী । সেই দ্রোহের  স্বতন্ত্র ওমূর্ত প্রকাশ ছিলো সিকান্দার আবু জাফর, সাবদার সিদ্দিকি এবং পরবর্তীকালেরসুনীল সাইফুল্লাহর মধ্যে । সমগ্রের মধ্যে এক গহন ছুরির মতো প্রবেশেরঅসাধারণ ক্ষমতা ছিলো শেষোক্ত দু’জনের ।